১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ রদ
Partition Of Bengal 1905
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ রদ
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন : প্রিয় পাঠকেরা আজকে আমরা আলোচনা করবো বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫ ) এবং বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১ ) নিয়ে। (Partition Of Bengal 1905 )
ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা (১৯০৫ সালের ) ভারতের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ব্রিটিশ ভারতে অখণ্ড বঙ্গদেশ বিভাজনের প্রক্রিয়াটি বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। এই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন আন্দোলন নামে পরিচিত।
দেখে নাও : ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ / আন্দোলন / বৈপ্লবিক ঘটনাসমূহ ও নেতৃবৃন্দ
বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার প্রেক্ষাপট
- ১৮৫৩ সালে চালর্স গ্রান্ট প্রথম বাংলা প্রদেশকে দুভাগ করার প্রস্তাব দেন।
- ১৮৫৪ সালে ডালহৌসিও একটি প্রস্তাব দেন।
- ১৮৬৬ সালের ওড়িশার দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ের অনুসন্ধানের জন্য যে কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল সেই কমিটিও একই সুপারিশ করে।
- ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ভারতের বড়লাট হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন বাংলা প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল সমগ্র ভারত উপমহাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। লর্ড কার্জন প্রথম থেকেই এত বড় প্রদেশ রাখা অনুচিত মনে করেন।
- ১৯০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ও আসামের সীমা রদ-বদলের প্রস্তাব দেয় । ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব হয়। কিন্তু এই প্ররিকল্পনাটি প্রবল গণ-অসন্তোষের শিকার হয়।
- ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কার্জন পূর্ববঙ্গে এসে সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী উত্তেজনা লক্ষ্য করেন।
- চতুর কার্জন নতুন প্রদেশে ঢাকাকে রাজধানী করার প্রস্তাব দেন এবং সেই অঞ্চলে মুসলিমদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেন।
- নতুন বিন্যাসে আসামের সাথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ছাড়াও দার্জিলিং বাদে জলপাইগুড়ি, পার্বত্য ত্রিপুরা ও মালদহ অন্তর্ভুক্ত হয়।
- ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর অবশেষে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়।
- স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার নতুন প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত হন।
দেখে নাও : তেভাগা আন্দোলন টিকা – Tebhaga Movement
বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন
- ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন তীব্রভাবে প্রকাশ পায়।
- হিন্দু রাজনীতিবিদ, জমিদার, সাংবাদিক, আইনজীবীরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা বঙ্গভঙ্গকে বাঙালি বিরোধী, জাতীয়তাবাদ বিরোধী ও বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ প্রভৃতি বলে আখ্যায়িত করেন।
- সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বাল গঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দু ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
- যেদিন বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হয়, তার পরের বছর ওই দিনে জাতীয় কংগ্রেস শোক দিবস পালন করে।
- বাঙালিরা ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক “রাখি বন্ধন” উৎসব পালন করে । ১৬ই অক্টোবর সব ধরণের কাজ বন্ধ রেখে খালি পায়ে গঙ্গা স্নান করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং রাখি বন্ধন উৎসবে অংশ নেন।
- ১৯০৬ সালের ৭ই আগস্ট স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়ে। এই কর্মসূচির আওতায় বিলেতি পণ্য যুক্ত, বিলেতি পণ্যে অগ্নিসংযোগ এবং ছাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসে।
- বিভিন্ন পত্রিকাগুলি ব্রিটিশ সরকারের ওপর বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য চাপ দিয়ে থাকে। এদের মধ্যে বেঙ্গলী, অমৃতবাজার পত্রিকা স্বদেশী ও বর্জন আন্দোলনের পক্ষে ভূমিকা গ্রহণ করে।
- স্বদেশী আন্দোলন ক্রমে স্বরাজ আন্দোলনে পরিণত হতে থাকে যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি।
- গান্ধীজি এ সম্পর্কে বলেন –
বঙ্গভঙ্গের পরেই ভারতের প্রকৃত জাগরণ ঘটেছে। এই বঙ্গভঙ্গই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভাগের কারণ হবে।
– মহাত্মা গান্ধী
- বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রকট রূপ ধারণ করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার ক্রমশ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হতে থাকে।
- ১৯০৬ সালে পূর্ববাংলা ও আসামের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলার পদত্যাগ করেন।
- ১৯১০ সাল থেকেই ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য গোপনে কাজ করতে থাকে।
- ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর দিল্লি দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন।
বঙ্গভঙ্গ-আইন বাতিল
- ব্রিটিশ-রাজ সপ্তম এডওয়ার্ড মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মে তে। তাঁর পুত্র পঞ্চম জর্জের অভিষেক হয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন।
- ৯ নভেম্বর, ভারতের উদ্দেশে পঞ্চম জর্জ রানি মেরি-সহ ইংলন্ড থেকে রওনা হন এবং ৭ ডিসেম্বর রাজকীয় শোভাযাত্রা সহকারে তিনি দিল্লির দরবারে পৌঁছান।
- ১২ ডিসেম্বর তিনি দিল্লির দরবারে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি ঘোষণা ছিল –
- পূর্বতন বাংলা ও পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ থেকে যথাক্রমে বিহার ও আসামকে বিচ্ছিন্ন করে অখন্ড বাংলাপ্রদেশ গঠিত হবে।
- বাংলা প্রদেশ প্রেসিডেন্সি স্তরে উন্নীত করে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের স্থানে গভর্নরের শাসনাধীনে আনা হবে।
- কলকাতার পরিবর্তে দিল্লি হবে ভারতের রাজধানী।
এ-ঘোষণার দ্বারাই ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের আইনটি বাতিল হয়ে যায়। মূলত হিন্দু বাঙালিরা এই আইন বাতিলের কারণে আনন্দিত হন। তাঁরা কলকাতায় ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি, পঞ্চম জর্জকে বিপুল সংবর্ধনা দেন। ১৯১২ সালের ২৫ জুন ভারত শাসন আইন পাশ হয়। মাদ্রাজের সে-সময়কার জনপ্রিয় গভর্নর লর্ড মাইকেল বাংলার গভর্নর হিসেবে ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল যোগদান করেন।
দেখে নাও : ভারত ছাড়ো আন্দোলন – Quit India Movement
বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন-
- (ক) লর্ড ডালহৌসি
- (খ) লর্ড কার্জন
- (গ) লর্ড রিপন
- (ঘ) লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ।
উত্তর : (খ) লর্ড কার্জন
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় ১৯০৫ সালের-
- (ক) ১৬ জানুয়ারি
- (খ) ১৬ আগস্ট
- (গ) ১৬ অক্টোবর
- (ঘ) ১৬ ডিসেম্বর।
উত্তর : (গ) ১৬ অক্টোবর
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর বাংলা ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর হন-
- (ক) লর্ড কার্জন
- (খ) লর্ড রিপন
- (গ) লর্ড হার্ডিঞ্জ
- (ঘ) ব্যামফিল্ড ফুলার।
উত্তর : (ঘ) ব্যামফিল্ড ফুলার।
বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত নতুন আন্দোলনের নাম-
- (ক) স্বদেশী আন্দোলন
- (খ) অসহযোগ আন্দোলন
- (গ) সশস্ত্র আন্দোলন
- (ঘ) খিলাফত আন্দোলন ৷
উত্তর : স্বদেশী আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হয় ১৯১১ সালের –
- (ক) ১২ জানুয়ারি
- (খ) ১২ অক্টোবর
- (গ) ১২ নভেম্বর
- (ঘ) ১২ ডিসেম্বর।
উত্তর : (ঘ) ১২ ডিসেম্বর।
বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন-
- (ক) পঞ্চম জর্জ
- (খ) লর্ড কার্জন
- (গ) লর্ড হার্ডিঞ্জ
- (ঘ) লর্ড মিন্টো
উত্তর : (ক) পঞ্চম জর্জ
To check our latest Posts - Click Here