ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৮০ – ১৮০০ ) – Fakir-Sannyasi Resistance
Fakir-Sannyasi Resistance
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৮০ – ১৮০০ )
আজকে আমরা জেনে নেবো ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৮০ – ১৮০০ ) সম্পর্কে। ফকির-সন্ন্য়সী বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ। Fakir-Sannyasi Resistance ।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে বাংলায় প্রায় প্রতিটি খেলতে কোম্পানির হস্তক্ষেপ ও নতুন নতুন ব্যবস্থার প্রচলনের ফলে বাংলার বিভিন্ন শ্রেণীর সনাতন অধিকার ও সুবিধা নষ্ট হতে থাকে। এর ফলে এই শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে ক্রমশ ক্ষোভ পুঞ্জীভূত থাকে এবং ক্রমশ সেই ক্ষোভ স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহের সূত্রপাত করে। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল এদের মধ্যে অন্যতম।
আরও দেখে নাও : সাঁওতাল বিদ্রোহ – কারণ, নেতা, পতনের কারণ – Santhal rebellion
ফকির-সন্ন্যাসীদের পরিচয়
ফকির-সন্ন্যাসীরা অধিকাংশই ছিলেন বাংলারই অধিবাসী। এরা ছিলেন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষ একটি দল। এদের অধিকাংশই ছিল অবিবাহিত এবং সংসারত্যাগী। সাধনায় সিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ঘুরে বেড়াতেন এবং সুযোগমত আস্তানা গড়ে তুলতেন। এদের মধ্যে অনেকেই বিবস্ত্র অবস্থায় চলাফেরা করতেন। উল্লেখ্য যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় গোষ্ঠিত লোকেরাই এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। ফকিররা ছিলেন মাদারিয়া সূফী সম্প্রদায়ভুক্ত আর সন্ন্যাসীগণ ছিলেন বেদান্তের মায়াবাদে বিশ্বাসী।
আরও দেখে নাও : নীল বিদ্রোহ – কারণ ফলাফল – Indigo Revolt
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কারণ
পলাশী যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা হলে ফকির-সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ শুরু করে । এর মুখ্য কারণগুলি ছিল –
- সন্ন্যাসী-ফকিরদের স্বাধীন চলাফেরায় কোম্পানি সরকার বাধা সৃষ্টি করে। এতে তাদের তীর্থস্থান ভ্রমণ ও ধর্মানুষ্ঠানে অবাধ যাতায়াতের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। ফলে তারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে।
- সরকার ফকির-সন্ন্যাসীদের ডাকাত-দস্যু হিসেবে আখ্যায়িত করে জমিদারর সাহায্যে তাদের দমনের চেষ্টা করেণ। এমতাবস্থায় নিজেদের স্বার্থের বিরােধী কোম্পানি সরকারকে উৎখাত করার জন্য ফকির-সন্ন্যাসীরা সশস্ত্র বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়।
- ফকির-সন্ন্যাসীরা গ্রামবাসীদের কাছ হতে ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। সরকার এই ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহকে বে-আইনী ঘােষণা করে তাদের জীবিকার পথ রুদ্ধ করে দেয় ।
- ১৭৭১ সালে, ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। এটি ছিল অনেকগুলো কারণের একটি যা ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এ ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় সংঘাতে।
আরও দেখে নাও : ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ / আন্দোলন / বৈপ্লবিক ঘটনাসমূহ ও নেতৃবৃন্দ
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ ও নেতৃবৃন্দ
মাদারিপন্থী নেতা ফকির মজনু শাহ বুরহানা ছিলেন ফকির আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ও নেতা। অন্যদিকে সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভবানী।
এদের নেতৃত্ব ১৭৬০ সালে বর্ধমান হতে এ সশস্ত্র বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় এবং ১৮০০ সালের মধ্যে ঢাকা, রংপুর,
রাজশাহী, ময়মনসিংহ, বগুড়া, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়। তবে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের তীব্রতা ছিল উত্তর বঙ্গে।
১৭৬০ সালে বিচ্ছিন্নভাবে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৭৬৩ সালে বিদ্রোহ পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহের রূপ নেয় এবং জোরদার হয়ে ওঠে। বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল ছিল কোম্পানির কুঠি, ইংরেজ শাসকের অনুগত জমিদারদের কাচারি এবং জমিদারি আমলাদের আবাসস্থল। বিদ্রোহীরা যুদ্ধে তরবারি, বর্শা, বল্লম, বন্দুক, অগ্নি নিক্ষেপক যন্ত্র, হাওয়াই ও ঘুর্ণায়মান কামান ব্যবহার করত। বিদ্রোহীদের রণকৌশল ছিল অতর্কিত আক্রমণ ও শত্রুর ক্ষতি সাধন করে নিরাপদে পলায়ন। এ রণকৌশল ব্যবহার করে ফকির-সন্ন্যাসীরা কোম্পানির কুঠি লুঠ এবং অনেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে।
- ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ফকির নেতা মজনু শাহ-এর নেতৃত্বে ফকির বাহিনীর সাথে সশস্ত্র ব্রিটিশদের সংঘর্ষে ১৫০ জন ফকির মারা যান।
- ১৭৭৩ সালে ময়মনসিংহে ফকিরদের সাথে সংঘর্ষে ব্রিটিশ সেনাপতি এডওয়ার্ডের মৃত্যু হয়।
- ১৭৭৬ সালে ফকিরদের গুলিতে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা রবার্টসন গুরুতরভাবে আহত হন।
- ১৭৮২-৮৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীরা রংপুরে প্রজাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
- ১৭৮৬ সালে ক্যাপ্টেন এ . ব্রেনানের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের অর্তকিত হামলায় বগুড়ার নিকট মহাস্থানগড়ের ফকিরবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও মজনু শাহ গুরুতরভাবে আহত হন।
- মজনু শাহের মৃত্যুর পর তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবহান শাহ, মাদার বখ্শ, জরিশাহ, করিম শাহ, কৃপানাথ, রওশন শাহ, অনুপ নারায়ণ ও শ্রীনিবাস প্রমুখ ১৮১২ সাল পর্যন্ত ফকির-সন্ন্যাসদের বিদ্রোহ অব্যাহত রাখেন। তবে মজনু শাহের মৃত্যুর পর এই আন্দোলন ক্রমশ তার সঠিক দিকনির্দেশনা ও গতিশীলতা হারাতে থাকে। আঠারো শতকের নববইয়ের দশকের শেষদিকে বিদ্রোহ অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী দশকে বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয়।
আরও দেখে নাও : সিপাহী বিদ্রোহ – মহাবিদ্রোহ ( Note, Video – MCQ, PDF )
বিদ্রোহ দমনে কোম্পানির পদক্ষেপ
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ দমনের লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস তৎপর হন। কোম্পানির সৈন্যদের সাথে মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। তবে কখনও তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। ১৭৮৭ সালে মজনু শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, সােবাহনা শাহ, মাদার বকস্ এবংকরিম শাহ্ প্রমুখ ফকিরদের নেতৃত্ব দেন। এরা সবাই ছিলেন মজনু শাহের আত্মীয়। ১৭৮৭ সালে ইংরেজদের সাথে এক যুদ্ধে সন্ন্যাসী নেতা ভবানী পাঠকও নিহত হন। তার মৃত্যুতে প্রতিরােধ আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৮০০ সাল নাগাদ বিদ্রোহীরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়।
বিদ্রোহের ব্যর্থতা ও এর কারণ
কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও ধীরে ধীরে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এই বিদ্রোহের ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলি ছিল –
- ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ব্যর্থতার প্রধান কারণ ছিল তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের অভাব । মজনুশাহের মৃত্যুর পর ফকিরদের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল আন্দোলনকে ক্রমশ দুর্বল করে তােলে।
- ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিল ভ্রাম্যমাণ । স্থানীয় লােকদের সাথে তাদের পরিচয় ও যােগাযােগ ছিল কম। তাছাড়া মুষ্টি সংগ্রহের জন্য অনেক সময় তারা স্থানীয় জনগণের উপর বল প্রয়ােগ করতেন। তাই এ বিদ্রোহে তারা স্থানীয় জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়।
- কোম্পানির সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি, তাদের উন্নত রণকৌশল, যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং সামরিক প্রযুক্তির কাছে ফকির-সন্ন্যাসীদের পরাজয় ছিল অনিবার্য।
To check our latest Posts - Click Here