চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত – Permanent Settlement
প্রিয় বন্ধুরা, আজ আমরা জেনে নেবো ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলা ও সংলগ্ন অঞ্চলে প্রচলিত ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement ) -এর বিষয়ে কিছু তথ্য। জেনে নেবো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (chirosthayi bondobosto) কি?, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য, শর্তাবলী (বৈশিষ্ট), সুফল-কুফল এবং অবসানের বিষয়ে।
এবং সবশেষে থাকবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন।
দেখে নাও : বাংলার গভর্নর জেনারেল তালিকা ও তথ্য – PDF
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি?
- বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩ সালে গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস-এর নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা কার্যকর করা হয়েছিল।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মূলত জমির রাজস্ব নির্ধারণের জন্য কোম্পানি এবং জমিদারদের মধ্যে একটি চুক্তি-ব্যবস্থা ছিল।
- এই ব্যবস্থা প্রথমে বাংলা, বিহার এবং ওড়িশায় প্রবর্তিত হয়, পরে উত্তর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এবং বারাণসী জেলাতেও এটি অনুসরণ করা হয়।
- কর্নওয়ালিস ইংল্যান্ডে প্রচলিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন, যেখানে জমিদাররা তাদের জমির স্থায়ী মালিক ছিলেন এবং তারা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতেন এবং ইংল্যান্ড সরকারেরও স্বার্থসিদ্ধি হতো।
- তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভারতে জমিদারদের একটি বংশানুক্রমিক শ্রেণীর সৃষ্টির কল্পনা করেছিলেন।
- এই ব্যবস্থাকে ‘জমিদারি প্রথা‘-ও বলা হত।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলনের পটভূমি :
- বাংলায় ব্রিটিশ আবির্ভাবের আগে বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় এক শ্রেণীর জমিদার ছিল যারা মুঘল সম্রাট বা তার প্রতিনিধি দেওয়ানদের পক্ষ থেকে জমির রাজস্ব আদায় করত।
- ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের পর, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলার দেওয়ানি দেওয়া হয়।
- কিন্তু তখন কোম্পানি গ্রামীণ এলাকার অসংখ্য কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়ে উঠছিলোনা।
- স্থানীয় আইন ও রীতিনীতি সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণাও ছিল না।
- পরে, ওয়ারেন হেস্টিংস পঞ্চবার্ষিক পরিদর্শনের মতো (five-yearly inspections) কিছু সংস্কার আনার চেষ্টা করেছিলেন।
- কিন্তু এসব কিছুই তেমন ভাবে লাভজনক হয়নি।
- তারপরে, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট-এর নির্দেশে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৬ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাব দেন। এটি ব্যবস্থা ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন (Permanent Settlement Act of 1793) দ্বারা কার্যকর হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলনের উদ্দেশ্য :
- কোম্পানি আয় সুনিশ্চিত করা : ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভেবে ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পনি নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব আদায়ে সক্ষম হবে।
- জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি : কোম্পানি চেয়েছিলো দেশে এক ধনী জমিদার সম্প্রদায় তৈরী করতে যা কোম্পানির হয়ে কাজ করবে।
- কৃষকদের উন্নতি : কোম্পানি ভেবেছিল বার বার জমিদার পরিবর্তন না করে যদি কোনো গ্রামের জন্য একজন স্থায়ী জমিদার নিয়োগ করা যায় তবে কৃষকদের সাথে জমিদারদের ঘনিষ্টতা বাড়বে এবং জমিদাররা নিজ স্বার্থ-সমৃদ্ধি ছাড়া কৃষকদের নিয়েও ভাববে ও তাদের উন্নতির চেষ্টা করবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য (শর্তাবলী) :
- জমিদাররা বংশানুক্রমিক ভাবে জমির মালিকানা ভোগ করতে পারবে।
- জমিদাররা তাদের ইচ্ছামতো জমি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবে।
- জমিদারের মালিকানা চীরজীবন থাকবে যদি সে নির্ধারিত তারিখে সূর্যাস্ত হওয়ার আগে সরকারকে নির্দিষ্ট রাজস্ব প্রদান করতে পারে। যদি অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয় তবে তাদের জমিতে আর কোনো অধিকার থাকবেনা এবং জমি নিলাম করা হবে। এই আইনটিকে ‘সূর্যাস্ত আইন’ বলা হত।
- জমিদার-কর্তৃক সরকারকে দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত ছিল এবং চুক্তিতে বলা হয়েছিল তা ভবিষ্যতে কোনোদিন বাড়বে না।
- নির্ধারিত পরিমাটি ছিল আদায় করা রাজস্বের শতকরা ৯০ ভাগ সরকারের এবং ১০ ভাগ জমিদারের। এই রাজস্বের হার ইংল্যান্ডে প্রচলিত হারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
- খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ বা অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে রাজস্ব মুকুব করা হবে না।
- জমিদারকে একটি পাট্টাও দিতে হত যাতে তাকে দেওয়া জমির ক্ষেত্রফল এবং সরকারকে যে খাজনা দিতে হত তার পরিমান বর্ণনা করা থাকত।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল :
সুফল :
- কৃষকদের দায়িত্ব ভারতীয় জমিদারদের কাঁধে এসে পড়ে। একই দেশের বাসিন্দা হওয়াই তারা বিভিন্ন গ্রামের সুদূর কোণে পৌঁছাতে পারত এবং স্থানীয় রীতিনীতিও খুব ভালোভাবে বুঝতে পারত এবং সহজেই রাজস্ব আদায় করতে পারতো।
- জমির প্রতি স্থায়ী অধিকার থাকায়, জমিদাররা নিরাপত্তা বোধ করতো, ফলে কৃষকদের সাথে তাদের ঘনিষ্টতাও বেড়ে ওঠে। নিজের জমি হওয়ায় জমিদাররা তা উন্নয়নের চেষ্টা করে ফলে জমির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ও কৃষকদের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।
- কোম্পানি জানত যে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্বই পাবে। জমিদারদেরও নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের জন্য আশ্বস্ত করা হয়েছিল। এমনকি কৃষকরাও কোম্পানি প্রদত্ত পাট্টার ফলে নিশ্চিত ছিল যে জমিদার তাদের ঠকাচ্ছেনা অর্থাৎ তাদেরও নির্দিষ্ট পরিমান রাজস্বই দিতে হত।
কুফল :
- এই বন্দোবস্তের ফলে মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। কৃষকদের জমিতে কোনো অধিকার না থাকায় কৃষক রা জমির মান উন্নয়নে কোনো রকম সহযোগিতা দেখাতো না।
- কোনোরকম জরিপ ছাড়াই অনেক ক্ষেত্রে কর ধার্য করা হত, এর ফল বসত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজস্বের পরিমাণ অনেকটা বেশিই দাবি করে ফেলতো কোম্পানি, যা সময় মতো শোধ করতে না পারায় জমিদারদের জমিদারি সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হত।
- করের পরিমাণ কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত ছিল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে লোভী জমিদারেরা কৃষকদের সাথে জোর করে বেশি খাজনা নিতো ও কোম্পানিকে নির্দিষ্ট রাজস্ব দিয়ে নিজের লাভের পরিমাণ বাড়াতো।
- জমিদারদের অনেকেই ছিলেন শহরবাসী ও অনভিজ্ঞ, যাদের জমি বা গ্রামের সাথে কোনো সম্পর্কই ছিলনা। ফলে এক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়, যারা নিপীড়ণের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে অনেক বেশি হারে রাজস্ব সংগ্রহ করে নিজেদের অর্থাগম করতো।
- চির স্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শিল্প ও বাণিজ্যের চরম ক্ষতি হয়। কারণ, শহুরে পুঁজিবাদী শ্রেণীর লোকেরা শিল্প বাণিজ্য ছেড়ে অধিক লাভের আশায় জমিদার হওয়ার জন্য ভূমিতে মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকে।
আরও দেখে নাও :
To check our latest Posts - Click Here