নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় – অবস্থান প্রতিষ্ঠাতা বিস্তার পুনর্নির্মাণ
আজকে আমরা ঐতিহাসিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। জেনে নেওয়া যাক প্রাচীন ভারতের এই ঐতিহ্যশালী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় – অবস্থান প্রতিষ্ঠাতা বিস্তার পুনর্নির্মাণ ।
অবস্থান
নালন্দার অবস্থান প্রাচীন মগধ রাজ্যের রাজগৃহে (রাজগীর) ছিল। বর্তমানে এই স্থানটি বিহার রাজ্যের নালন্দা জেলায় অবস্থিত।
স্থাপনা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা হয়েছিল আনুমানিক খৃষ্টীয় পঞ্চম শতকে – গুপ্ত বংশের সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে। নালন্দায় প্রথম কুমারগুপ্তের নামাঙ্কিত মুদ্রাও পাওয়া গেছে।
নালন্দা প্রকৃতপক্ষে একটি বৌদ্ধ মহাবিহার।
গুপ্ত রাজবংশের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে নালন্দার প্রতিষ্ঠা হলেও একটি সমৃদ্ধ জনপদ তথা বৌদ্ধ মহাবিহার হিসাবে নালন্দার উল্লেখ ইতিহাসে অনেক আগের সময় থেকেই পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ ইতিহাস থেকে জানা যায় গৌতম বুদ্ধ নালন্দার নিকটবর্তী আম্রকাননে উপদেশ প্রদান করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের শিষ্য সারিপুত্ত নালন্দাতে জন্মগ্রহণ করেন, এবং নালন্দাতেই নির্বাণলাভ করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে আরও জানতে পারা যায় যে বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনও নালন্দারই অধিবাসী ছিলেন।
প্রসঙ্গতঃ, উপরিউক্ত বিবরণসমূহ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া গেলেও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। নালন্দার প্রামাণ্য ঐতিহাসিক বিবরণের সূচনা গুপ্তযুগেই।
ফা হিয়েন
প্রখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন ভারতে খৃঃ পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে ভারতে আগমন করেন, এবং প্রায় দশ বৎসরকাল ভারতে অবস্থান করেন। তাঁর বিবরণে নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গতঃ, তাঁর বিবরণে কিন্তু নালন্দার মহাবিহার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
বিস্তার
প্রথম কুমারগুপ্তের উত্তরসূরী বুধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্য, বজ্র প্রমুখ পরবর্তীকালে অনেকগুলি মঠ এবং ভবন নির্মাণ করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্ধন করেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সমসাময়িক অসংখ্য লিপি, চিত্রকলা, এবং মুদ্রায় পাওয়া যায়।
গুপ্ত-পরবর্তী যুগ
গুপ্ত বংশের পতনের পরেও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের রাজা এবং সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এসেছে। মধ্য ভারতের জনৈক রাজা নালন্দা মহাবিহার চত্বরের অট্টালিকাগুলিকে পরিবেষ্টন করে একদ্বারবিশিষ্ট উচ্চ একটি প্রাচীন নির্মাণ করান। পূর্ণবর্মণ নামে আরেকজন রাজা আশি ফুট উঁচু তামার একটি বুদ্ধমূর্তি এবং তৎসংলগ্ন বেদী নির্মাণ করান।
তবে গুপ্তোত্তর যুগের সম্ভবতঃ সবথেকে বড় এবং প্রসিদ্ধ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন খৃঃ সপ্তম শতকের থানেশ্বর এবং কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধন, যাঁকে বৌদ্ধ সাহিত্যে শিলাদিত্য নামে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কথিত আছে, তিনি একশটি গ্রাম থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব নালন্দার জন্য মঞ্জুর করেছিলেন। এছাড়াও তিনি সেই গ্রামগুলির দুইশত জন গৃহস্থকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন মহাবিহারের ভিক্ষুদের চাহিদা অনুসারে রোজ চাল, মাখন, ও দুধ সরবরাহ করেন। নালন্দার প্রায় এক হাজার ভিক্ষু কনৌজে হর্ষবর্ধনের রাজকীয় উপাসনা সভায় উপস্থিত থাকতেন।
ঐতিহাসিকদের অনুমান, রাজা হর্ষবর্ধন পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন। প্রসঙ্গতঃ, হর্ষবর্ধন নিজেকে শৈব বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। সুতরাং, তিনি যদি আদৌ বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেও থাকেন তাহলেও তা করেছিলেন তাঁর জীবনকালের একেবারে শেষের দিকে।
হিউয়েন সাং
প্রখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারতে খৃঃ সপ্তম শতকে (খৃঃ ৬৩০ – খৃঃ ৬৪৩) ভারতে আসেন, এবং দুইবার নালন্দা পরিদর্শন করেন – প্রথমে খৃঃ ৬৩৭ -এ, দ্বিতীয়বার খৃঃ ৬৪২ -এ। তিনি সর্বমোট দুই বৎসরকাল নালন্দায় ছিলেন।
হিউয়েন সাং নালন্দায় সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন, এবং নালন্দায় অবস্থানকালে তিনি মোক্ষদেব নামেও পরিচিত হয়েছিলেন। নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্রের অধীনে তিনি নালন্দায় অধ্যয়ন করেন। হিউয়েন সাঙের মতে শীলভদ্র যোগাচার নামক বৌদ্ধ দর্শনের একজন অতুলনীয় শিক্ষক ছিলেন। এই যোগাচার দর্শন কিয়দাংশে চীনেও প্রচারিত হয়েছিল।
নালন্দায় অবস্থানকালে হিউয়েন বৌদ্ধ দর্শন ব্যতীত ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, এবং সংস্কৃত শিক্ষাও লাভ করেন।
হিউয়েন সাঙের নিজের বিবরণে নালন্দাঃ
…ইহা ব্যতীত, সমগ্র স্থানটি ইষ্টকনির্মিত একটি প্রাচীরের দ্বারা পরিবেষ্টিত, যা সমগ্র মহাবিহারটিকে বাইরের দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। একটি দ্বার মহাবিদ্যালয়ের প্রবেশপথে, যে মহাবিদ্যালয় থেকে [মহাবিহারের] অপর আটটি কক্ষ সংযুক্ত। সুসজ্জিত স্তম্ভ ও পরীসদৃশ স্তম্ভশীর্ষগুলি সূচালো পর্বতশীর্ষের ন্যায় সন্নিবেশিত। মানমন্দিরগুলি যেন [সকালের] কুয়াশাবৃত, এবং স্তম্ভশীর্ষের কক্ষগুলি যেন মেঘের মধ্যে অবলুপ্ত।
– হিউয়েন সাঙ
চীনদেশে প্রত্যাবর্তনকালে হিউয়েন সাং ২০ অশ্বপৃষ্ঠে ৫২০ টি পেটিকায় করে ৬৫৭ টি সংস্কৃত পুঁথি এবং ১৫০ টি মূল্যবান সামগ্রী সঙ্গে করে নিয়ে যান। তিনি এরমধ্যে ৭৪ টি পুঁথি অনুবাদও করেছিলেন।
পাল যুগ
খৃঃ অষ্টম শতকে পাল বংশ বাংলা তথা উত্তর-পূর্ব ভারতে ক্ষমতাসীন হয়। পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
অসংখ্য শিলালিপি ও সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায় যে গুপ্ত যুগের তথা হর্ষবর্ধনের সময়ের মত পাল যুগেও নালন্দা পাল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। পাল যুগে নালন্দায় মহাযান বৌদ্ধধর্মের সাথে সাথে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের শিক্ষণও শুরু হয়। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটি তন্ত্র-মন্ত্র প্রভাবিত তথা পৌত্তলিক ধারা, যা সমসাময়িককালে ভারতে বিস্তারলাভ করেছিল।
পাল রাজারা নালন্দার পৃষ্ঠপোষকতার সাথে সাথে আরও চারটি সুবিখ্যাত মহাবিহার নির্মাণ করেন – জগদ্দল, বিক্রমশীলা, সোমপুর, এবং ওদন্তপুরী। বিক্রমশীলার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা ধর্মপাল এবং সোমপুরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দেবপাল। পালযুগে অন্যান্য মহাবিহারগুলি নালন্দা থেকে অনেক শিক্ষিত ভিক্ষুকে গ্রহণ করায় নালন্দা একক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
ধ্বংস
নালন্দার প্রায় হাজার বছরের ইতিহাসে নালন্দা বহুবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়।
প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (খৃঃ ৪৫৫ – খৃঃ৪৬৭) মিহিরকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার হুণরা নালন্দা আক্রমণ করে। তারা বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর বংশধররা নালন্দার পুনর্গঠন করেন।
খৃঃ ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি নালন্দা এবং পূর্ব ভারতের অপরাপর বৌদ্ধমঠ তথা মহাবিহারগুলি আক্রমণ তথা ধ্বংস করেন। মিনহাজউদ্দিন সিরাজের তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে বৌদ্ধমঠের এবং মঠের ভিক্ষুদের উপর আক্রমণ করেন এবং মঠে অবস্থানরত হিন্দুদের হত্যা করার বর্ণনা পাওয়া যায়। নালন্দার ঐতিহাসিক গ্রন্থাগারও তুর্কি আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এর পরেও বিভিন্ন বিবরণে নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে সেই নালন্দা ছিল ঐতিহাসিক নালন্দার ছায়ামাত্র।
খনন
খৃঃ ১৮১১-১২ সালে ব্রিটিশ ভৌগোলিক এবং চিকিৎসক ফ্রান্সিস বুখানন-হ্যামিলটন প্রথম নালন্দার ভগ্নাবশেষের সমীক্ষা করেন। যদিও তিনি সেই ভগ্নাবশেষকে ঐতিহাসিক নালন্দা মহাবিহার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেননি। আলেকজান্ডার ক্যানিংহ্যাম এবং ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ সংস্থা খৃঃ ১৮৬১-৬২ সালে প্রথম সরকারী সমীক্ষা করেন। তবে খৃঃ ১৯১৫ সালের পূর্বে নালন্দায় কোনো খননকার্য শুরু হয়নি। খৃঃ ১৯১৫ এর পরে কয়েক দফায় খৃঃ ১৯৮২ সাল অবধি নালন্দায় খননকার্য করা হয়।
নালন্দার ধ্বংসাবশেষ যে জমির উপর অবস্থিত তার দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে ১,৬০০ ফুট এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ৮০০ ফুট ছিল। এর সমগ্র ক্ষেত্রফল ছিল প্রায় ১২ হেক্টর।
পুনর্নিমানঃ
খৃঃ ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর নালন্দার নিকটবর্তী রাজগীরে ১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষাবর্ষের সূচনা ঘটে। বর্তমানে ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় নবনির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্ধন সম্পন্ন হচ্ছে।
নবনির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবদ শ্রী অমর্ত্য সেন। বর্তমানে নালন্দার অধ্যক্ষ শ্রীমতী সুনয়না সিংহ ( Last Updated : 31/01/2022 ) ।
To check our latest Posts - Click Here