ভারতের মৃত্তিকার শ্রেণীবিভাগ – বিভিন্ন ধরণের মৃত্তিকা
Different Types of Soils in India
ভারতের মৃত্তিকার শ্রেণীবিভাগ – বিভিন্ন ধরণের মৃত্তিকা
আজকের এই পোস্টে ভারতের মৃত্তিকার শ্রেণীবিভাগ বা বিভিন্ন ধরণের মৃত্তিকা বা ভারতের প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরণের মাটি নিয়ে আলোচনা করা রইলো। মৃত্তিকার উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য, শিলাস্তরের গঠন, উদ্ভিদের বিস্তার ও জলবায়ুর আঞ্চলিক তারতম্য অনুসারে ভারতের মৃত্তিকাকে নিন্মলিখিত ভাগে ভাগ করা হয়।
পলিমাটি
পলিমাটি : Alluvial Soil
অবস্থান : শতদ্রু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সমভূমি, মহানদী-গোদাবরী-কৃষ্ণা-কাবেরী নদীর উপত্যকা ও বদ্বীপ এবং উপকূলবর্তী অঞ্চল।
উৎপত্তি : হিমালয় পর্বতের পাললিক শিলা এবং দক্ষিণ ভারতের মালভূমি ও বিভিন্ন উচ্চভূমির কঠিন শিলা ক্ষয় করে বিভিন্ন নদনদী সমূহ তাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সঞ্চয়ের দ্বারা পলি মৃত্তিকা সৃষ্টি করে।
আয়তন : প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গকিমি। ভারতের মোট মৃত্তিকার ৪৫.৬% পলিমাটি।
উপবিভাগ : আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পলি মৃত্তিকা পাঁচ ধরনের হয়। যথা-
- খাদার : নদী তীরবর্তী অঞ্চলের নবীন পলি মৃত্তিকাকে খাদার বলে। এই মাটি খুব উর্বর । গঠন অনুসারে এই মাটি বেলে, এঁটেল ও দোঁয়াশ – এই তিন ভাগে বিভক্ত ।
- ভাঙ্গর : নদী থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের প্রাচীন পলি মৃত্তিকাকে ভাঙ্গর বলে।
- ভাবর : পর্বতের পাদদেশীয় অঞ্চলের নুড়ি, কাঁকর মিশ্রিত অনুর্বর মৃত্তিকাকে ভাবর বলে।
- ধাঙ্কার : উচ্চ গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের জলাভূমির মৃত্তিকাকে ধাঙ্কার বলে।
- কঙ্কর : ভাঙ্গড় অঞ্চলের দানা যুক্ত মৃত্তিকাকে কঙ্কর বলে।
বৈশিষ্ট্য :
- পলি মৃত্তিকার পলি, বালি ও কাদার ভাগ বেশি থাকে।
- সুষম গ্রথন যুক্ত বলে পলি মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা বেশি হয়।
- এই মৃত্তিকায় নাইটোজেন ও জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকলেও ফসফরাস ও পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি। তাই এই মৃত্তিকা উর্বর ও কৃষি কাজের উপযোগী।
- এই মৃত্তিকার রং গাঢ় হয়।
উৎপাদিত ফসল : অত্যন্ত উর্বর বলে পলি মৃত্তিকায় প্রায় সব ধরনের ফসল বিশেষত ধান, গম, পাট, আখ, আলু, শাকসবজি ও বিভিন্ন ধরনের তৈলবীজ চাষ করা হয়।
কৃষ্ণ মৃত্তিকা
কৃষ্ণ মৃত্তিকা : Black Soil
অবস্থান : দাক্ষিণাত্য মালভূমি – মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটকের অংশবিশেষ, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, তামিলনাড়ু।
উৎপত্তি : স্বল্প বৃষ্টিপাতের প্রভাবে কালো রঙের লাভা গঠিত ব্যাসল্ট শিলা থেকে কৃষ্ণ মৃত্তিকার উৎপত্তি হয়েছে।
আয়তন : প্রায় ৫.৪৬ লক্ষ বর্গকিমি। ভারতের মোট মৃত্তিকার ১৬.৬% কৃষ্ণমৃত্তিকা।
বৈশিষ্ট্য :
- ব্যাসল্ট শিলা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে এবং টাইটানিয়াম অক্সাইড ও বিভিন্ন জৈব যৌগের পরিমাণ বেশি থাকে বলে কৃষ্ণ মৃত্তিকার রং কালো হয়।
- কাদার ভাগ বেশি ও বালির ভাগ কম থাকায় কৃষ্ণ মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা খুব বেশি হয়।
- বর্ষাকালে কৃষ্ণ মৃত্তিকা চটচটে হয়,। কিন্তু শুষ্ক ঋতুতে জলের অভাবে এই মৃত্তিকা শক্ত হয়ে যায় এবং মৃত্তিকাতে বড় বড় ফাটল সৃষ্টি হয়।
- কৃষ্ণ মৃত্তিকায় ফসফরাস ও নাইট্রোজেনের ঘাটতি থাকলেও প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন অক্সাইড, অ্যালুমিনা ইত্যাদি উপস্থিত থাকে। এই মৃত্তিকা খুব উর্বর হয়।
- প্রচুর পরিমানে তুলো উৎপন্ন হয় বলে একে কালো তুলা মাটি বলে ।
- এই মাটি খুব উর্বর , এর জল ধারণ ক্ষমতা খুব বেশি ।
উৎপাদিত ফসল : কার্পাস বা তুলো, তামাক, তৈলবীজ, ইক্ষু, জোয়ার, পেঁয়াজ, কমলালেবু ও বিভিন্ন খাদ্য শস্য হল কৃষ্ণ মৃত্তিকা উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য ফসল। কৃষ্ণ মৃত্তিকায় কার্পাস বা তুলো প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় বলে একে কৃষ্ণ কার্পাস মৃত্তিকা বা ‘Black Cotton Soil’ বলা হয়।
লোহিত মৃত্তিকা
লোহিত মৃত্তিকা বা লাল মাটি : Red Soil
অবস্থান : সমগ্র তামিলনাড়ু, কর্ণাটকের অংশবিশেষ, মহারাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব , অন্ধ্র ও মধ্য প্রদেশের পূর্বাংশ, ছোটনাগপুর অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলা।
উৎপত্তি : অধিক উষ্ণতা ও আর্দ্রতার প্রভাবে প্রাচীন আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে লোহিত মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়েছে।
আয়তন : প্রায় ৩.৫ লক্ষ বর্গকিমি। ভারতের মোট মৃত্তিকার ১০.৬% লাল মাটি।
বৈশিষ্ট্য :
- উচ্চ অঞ্চলে লাল মাটি অনুর্বর ও নিম্ন অঞ্চলে উর্বর প্রকৃতির হয়।
- লোহিত মৃত্তিকায় লৌহের পরিমাণ বেশি থাকায় ইহা লাল রঙের হয়। তবে কখনো কখনো এই মৃত্তিকার রং হলুদ ও বাদামি ধূসর বর্ণেরও হয়ে থাকে।
- এই মৃত্তিকায় ফসফরাস, পলি ও বালির ভাগ বেশি থাকলেও নাইটোজেন, ক্যালসিয়াম ও জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম।
- এই মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা খুব বেশি এবং জল ধারণ ক্ষমতা খুব কম।
উৎপাদিত ফসল : লোহিত মৃত্তিকা অনুর্বর হলেও এই মৃত্তিকায় তামাক, চিনাবাদাম, সোয়াবিন, ভুট্টা, ইক্ষু, আঙুর ইত্যাদি ফসল চাষ করা হয়।
ল্যাটেরাইট মাটি
ল্যাটেরাইট মাটি : Laterite Soil
অবস্থান : পশ্চিমঘাট পর্বতের শীর্ষদেশে, পূর্বঘাট, রাজমহল পাহাড়, আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চল।
উৎপত্তি : ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে উচ্চভূমির আবহবিকারগ্রস্ত প্রাচীন শিলাস্তর থেকে সিলিকা ও অন্যান্য পদার্থ অপসারিত হয়ে যায় এবং লৌহা ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড পড়ে থাকে। এই লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড বায়ুর সংস্পর্শে ল্যাটেরাইজেশন প্রক্রিয়ায় জমাট বেঁধে ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।
আয়তন : প্রায় ২.৮৪ লক্ষ বর্গকিমি। ভারতের মোট মৃত্তিকার ৭.৫% ল্যাটেরাইট মাটি।
বৈশিষ্ট্য :
- এই মাটি মূলত অনুর্বর
- ল্যাটেরাইট মৃত্তিকায় লোহার ভাগ বেশি থাকে বলে ইহা ইঁটের মতো লাল রঙের হয়
- ল্যাটেরাইট মৃত্তিকায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম থাকে বলে এই মৃত্তিকা অনুর্বর হয়।
- কাঁকরে পরিপূর্ণ বলে এই মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা খুব কম।
- এই মৃত্তিকার গঠন বা আকৃতি অনেকটা মৌচাকের মতো হয়।
উৎপাদিত ফসল : রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ও জলসেচের সাহায্যে এই মৃত্তিকায় চিনাবাদাম, ভুট্টা, রাগি, রবার ইত্যাদি ফসল চাষ করা যায়।
লাল মাটি ও ল্যাটেরাইট মাটির পার্থক্য :
বিষয় | লালমাটি | ল্যাটেরাইট মাটি |
---|---|---|
সৃষ্টির কারণ | প্রাচীন গ্রানাইট নিস্ শিলার আবহবিকারের ফলে | উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ুতে ধৌত পক্রিয়ার দ্বারা |
খনিজ দ্রব্য | উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হয় না | বক্সাইট গঠিত হয় |
স্বাভাবিক উদ্ভিদ | শুস্ক পর্ণমোচী | আর্দ্র পর্ণমোচী |
মরু অঞ্চলের মাটি ‘
মরু অঞ্চলের মাটি : Arid and Desert Soil
অবস্থান : রাজস্থানের মরুভূমি ও সংলগ্ন পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং কচ্ছের রণের অংশবিশেষ।
উৎপত্তি : স্বল্প বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রভাবে বেলেপাথর জাতীয় শিলাস্তর থেকে মরু মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।
আয়তন : প্রায় ১.৪২ লক্ষ বর্গকিমি। ভারতের মোট মৃত্তিকার ৪.২১% মরু অঞ্চলের মাটি।
এই মাটি সিরোজেম নামেও পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য :
- স্বল্প বৃষ্টিপাত ও অধিক বাষ্পীভবন যুক্ত অঞ্চলে অধিক বাষ্পীভবনের কারণে কৈশিক প্রক্রিয়ায় ভূ-অভ্যন্তরের লবণ উপরে উঠে এসে মৃত্তিকা স্তরে সঞ্চিত হয় বলে এই মৃত্তিকা লবণাক্ত হয়।
- এই মৃত্তিকা বাদামি হলুদ বা হালকা হলুদ বর্ণের হয়।
- বালির ভাগ বেশি বলে এই মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা কম।
- মরু মৃত্তিকা অধ্যুষিত অঞ্চল উদ্ভিদ বিরল বলে এই মৃত্তিকায় নাইট্রোজেন ও জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকে। তাই এই মৃত্তিকা অনুর্বর।
উৎপাদিত ফসল : জল ধারণ ক্ষমতা কম ও অনুর্বর হওয়ার কারণে মরু মৃত্তিকায় কৃষিকাজ ভালো হয়না। তবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ও জলসেচের সাহায্যে এই মৃত্তিকায় গম, যব, মিলেট, কার্পাস, ডাল, তৈলবীজ ইত্যাদি ফসল চাষ করা হয়।
বনভূমি ও পার্বত্য মাটি
বনভূমি ও পার্বত্য মাটি : Forest and Mountain Soil
অবস্থান : বনভূমি দ্বারা আবৃত পার্বত্য অঞ্চলে দেখা যায়।
উৎপত্তি : শীতল পার্বত্য অঞ্চলে সরলবর্গীয় বৃক্ষের ডালপালা, লতাপাতা ইত্যাদি পচে গিয়ে শিলা চূর্ণের সাথে সংযুক্ত হয়ে পার্বত্য ও অরণ্য মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।
আয়তন : প্রায় ২.৮৫ লক্ষ বর্গকিমি। ভারতের মোট মৃত্তিকার ৪.৩২% বনভূমি ও পার্বত্য মাটি।
এই মাটি পডসল নামেও পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য :
- পার্বত্য ও অরণ্য মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে।
- বিভিন্ন আকৃতির নুড়ি, কাঁকর, বালি ইত্যাদির পরিমাণ বেশি থাকে বলে এই মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা খুব কম।
- এই মৃত্তিকা ধূসর বাদামি বা কালচে বর্ণের হয়।
- জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকলেও পটাশ, ফসফরাস ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম বলে এবং জল ধারণ ক্ষমতা কম বলে এই মৃত্তিকা অনুর্বর ও কৃষিকাজের অনুপোযোগী হয়।
উৎপাদিত ফসল : রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে এই মৃত্তিকায় চা, কফি, বিভিন্ন ধরনের মশলা ও ফল চাষ করা হয়।
অন্যান্য মাটি :
লবনাক্ত ও ক্ষারীয় মাটি
লবনাক্ত ও ক্ষারীয় মাটি : Saline and Alkaline Solis
অবস্থান : বিহার, উত্তর প্রদেশ , হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও রাজস্থানের শুস্ক বলয়ে এবং সমুদ্র উপকূলভাগে।
আয়তন : ৬৮০০ বর্গকিমি।
এই মাটি রে, কালার, ঊষর, থুর, রাকার, কার্ল এবং চোপান নামেও পরিচিত।
কারেওয়া মাটি
কারেওয়া মাটি : Karewa Soil
অবস্থান : কাশ্মীর উপত্যকা ও জম্বু ডিভিশনের ডোডো জেলার ভদ্রা উপত্যকায় কারেওয়া মাটি দেখা যায়।
সূক্ষ পলি, কাদা, বালি ও বোল্ডার দিয়ে এই মাটি গঠিত। এই মাটিতে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্ম ও কখনও পিট কয়লা পাওয়া যায়।
এই অঞ্চলে জাফরান, আলমন্ড, ওয়ালনাট, আপেল ও বিভিন্ন ফল চাষ হয়।
Download Section :
File Name : ভারতের মৃত্তিকার শ্রেণীবিভাগ – বিভিন্ন ধরণের মৃত্তিকা – বাংলা কুইজ
File Size : 2.8 MB
No. of Pages : 06
Format : PDF
আরও দেখে নাও :
- বিভিন্ন প্রকার শিলা ও তার শ্রেণীবিভাগ – PDF
- মেঘ কি ? মেঘ কতপ্রকার ও কি কি ? – PDF
- কয়লা ও তার শ্রেণীবিভাগ – বিভিন্ন ধরণের কয়লা – PDF
To check our latest Posts - Click Here
স্যার ডাউনলোড অপশন টা নেই ❓