ডালটনের পরমাণুবাদ – মূল বক্তব্য, ব্যাখ্যা, গুরুত্ব ও ত্রুটি
Dalton’s Atomic Theory
ডালটনের পরমাণুবাদ – মূল বক্তব্য, ব্যাখ্যা, গুরুত্ব ও ত্রুটি
রাসায়নিক সংযােগ সূত্রগুলির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে 1803 খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী জন ডালটন বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে পাওয়া ফলের ভিত্তিতে পরমাণু সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন। একে ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্ব বা ডালটনের পরমাণুবাদ (Dalton’s Atomic Theory) বলে। এই পরমাণুবাদের উপর নির্ভর করেই আধুনিক পরমাণু বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে। আজকে আমরা আলোচনা করবো ডালটনের পরমাণুবাদ – মূল বক্তব্য, ব্যাখ্যা, গুরুত্ব ও ত্রুটি । ডাল্টনের পরমাণুবাদ , ডাল্টনের পারমাণবিক তত্ত্ব।
দেখে নাও : ১১৮টি মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ও প্রতীক তালিকা
ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্ব বা পরমাণুবাদের মূল বক্তব্য :
- প্রত্যেক মৌলিক পদার্থ অসংখ্য অবিভাজ্য ও অতিক্ষুদ্র নিরেট কণা দিয়ে গঠিত। এই ক্ষুদ্রতম কণাকে পরমাণু (atom) বলে।
- কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে পরমাণুকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। পরমানি অবিনশ্বর এবং অবিভাজ্য। অর্থাৎ কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে পরমাণুর ওজন, ধর্ম অথবা আকারের পরিবর্তন করা যায় না।
- একই মৌলিক পদার্থের প্রতিটি পরমাণুর ভর ও ধর্ম এক রকমের।
- বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর ও ধর্ম আলাদা।
- রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলাে পূর্ণসংখ্যার সরল অনুপাতে যুক্ত হয়ে যৌগিক পদার্থ গঠন করে।
ডালটনের পরমাণুবাদের ব্যাখ্যা :
যে-কোন উৎস থেকে হাইড্রোজেন মৌলটিকে সংগ্রহ করা হােক না কেন, মৌলটি একই ভর ও ধর্মবিশিষ্ট পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত হবে। একইভাবে, অক্সিজেন মৌলের প্রতিটি পরমাণুও একই ভর ও একই ধর্মবিশিষ্ট। কিন্তু হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর ও ধর্ম, অক্সিজেন পরমাণুর ভর ও ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে হাইড্রোজেন বা অক্সিজেন মৌলের পরমাণুকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। আবার হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মৌলিক পদার্থ দুটির পরমাণু পরস্পর রাসায়নিক বিক্রিয়া করে জল যৌগটি উৎপন্ন করে। বিক্রিয়াটিতে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একটি অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক অণু জল গঠন করে। অতএব, জল (H20) গঠনে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণুর সংখ্যার অনুপাত হল 2:1; এটি একটি সরল অনুপাত। —অর্থাৎ, যৌগ গঠনে বিক্রিয়াকারী পরমাণুগুলি পরস্পর পূর্ণ সংখ্যার সরল অনুপাতে যুক্ত|
ডালটনের পরমাণুবাদের গুরুত্ব :
ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্ব রসায়নকে সুসংবদ্ধ বিজ্ঞান হিসাবে রূপদান করতে সমর্থ হয়েছে, যেমন :
- ডালটনের পরমাণুবাদেই সর্বপ্রথম মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হিসাবে পরমাণুর ধারণা করা হয়।
- ডালটনের পরমাণুবাদের সাহায্যে পদার্থের নিত্যতা সূত্র সহ অন্যান্য রাসায়নিক সংযােগসূত্রকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।
- বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলাে কিভাবে নিজেদের মধ্যে যুক্ত হয়ে যৌগিক পদার্থ গঠন করে, তা ডালটনের পরমাণুবাদ থেকেই সর্বপ্রথম জানা যায়।
- এই তত্ত্বের সাহায্যে ওজন সংক্রান্ত বিভিন্ন রাসায়নিক সংযােগ-সূত্রকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।
- পারমাণবিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই অ্যাভােগাড্রো অণুর কল্পনার মাধ্যমে ‘অ্যাভােগাড্রো-প্রকল্পটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
- এই তত্ত্বের সাহায্যে রাসায়নিক সংযােগ থেকে বিভিন্ন মৌলের পরমাণু দ্বারা কিভাবে ভিন্নধর্মী যৌগ গঠিত হয়, তা ব্যাখ্যা করা যায়।
- মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর এবং ধর্ম নির্দিষ্ট – এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে।
- বর্তমানে ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্ব ও অ্যাভােগাড্রো-প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
- এই পরমাণুতত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই পরমাণুর-গঠন সম্পর্কিত আধুনিক ধারণাটি গড়ে উঠেছে।
- ডালটনের পরমাণুবাদের সাহায্যে বিভিন্ন মৌলের আপেক্ষিক ওজন হিসাবে মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
ডালটনের পরমাণুবাদের ত্রুটি :
পরমাণুর গঠন সম্পর্কিত আধুনিক বিজ্ঞানের আলােকে ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্বে নিচের ত্রুটিগুলি দেখা যায় :
- বর্তমানে পরমাণুকে মৌলের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য নিরেট কণা বলে মনে করা হয় না। পরীক্ষালব্ধ ফল থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, পরমাণু ইলেকট্রন, প্রােটন ও নিউট্রন প্রভৃতি আরও ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। এছাড়া পরমাণুর নিউক্লিয়াস ও কক্ষপথে থাকা ইলেক্ট্রনের মধ্যে যথেষ্ট ফাকা স্থান রয়েছে—অর্থাৎ, পরমাণু নিরেট কণিকা নয়।
- আইসােটোপের আবিষ্কার থেকে জানা গিয়েছে একই মৌলিক পদার্থের বিভিন্ন ভর ও বিভিন্ন ভৌতধর্মবিশিষ্ট পরমাণু থাকতে পারে, অর্থাৎ, একই মৌলিক পদাথের পরমাণুগুলির ভর ও ধর্ম অভিন্ন বলে ডালটন যে সিদ্ধান্ত করেছিলেন, তা সঠিক নয়।
- ডালটনের পরমাণুবাদ অনুসারে পরমাণু অবিভাজ্য এবং পরমাণুকে ধ্বংস বা সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে বর্তমানে জানা গিয়েছে যে, ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, থােরিয়াম প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলাে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভেঙ্গে গিয়ে লঘুতর পারমাণবিক ওজন বিশিষ্ট একাধিক নতুন পরমাণুর সৃষ্টি করে। আবার অতি উচ্চ তাপমাত্রায় হাইড্রোজেনের মত হালকা মৌলের পরমাণুকে সংযােজিত করে ভিন্ন ধর্মের নতুন মৌল হিলিয়াম পরমাণু সৃষ্টি করা যায়। কাজেই পরমাণু অবিভাজ্য এবং পরমাণুকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না—ডালটনের পরমাণুবাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।
- বর্তমানে একই ভরবিশিষ্ট কিন্তু ভিন্ন ধর্ম যুক্ত পরমাণু পাওয়া গিয়েছে। যেমন, ক্যালসিয়াম ও আর্গনের পারমাণবিক ভর 40 ; এদের আইসােবার (Isober) বলে। ফলে, বিভিন্ন মৌলের পরমাণুর ভর পরস্পর বিভিন্ন—ডালটনের এই সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়।
- ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্বে মৌল ও যৌগের ক্ষুদ্রতম কণার মধ্যে কোন পার্থক্য নির্দেশ করা হয়নি। অ্যাভােগাড্রো সর্বপ্রথম অণুর কল্পনা করেন। তা থেকে জানা যায়—যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হচ্ছে অণু, পরমাণু নয়।
- গে-লুসাকের গ্যাস আয়তন সূত্রটি ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না।
আরো দেখে নাও :
বিভিন্ন পরিমাপক যন্ত্রসমূহের নাম ও কাজের তালিকা PDF
বিভিন্ন পদ্ধতিতে এককের রূপান্তর । Conversion of Units
SI পদ্ধতিতে বিভিন্ন ভৌত রাশির একক
পর্যায় সারণির মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্মসমূহ
বিভিন্ন ধাতু-সংকর ও তাদের ব্যবহার | সংকর ধাতু । List of Important Alloys and their Uses
pH মাত্রা – ধারণা, গুরুত্ব ও বিভিন্ন দ্রবনের মাত্রা
To check our latest Posts - Click Here