রাওলাট আইন – ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ
প্রিয় পাঠকেরা, আজকে আমরা আলোচনা করবো আধুনিক ভারতের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টপিক “রাওলাট আইন” নিয়ে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রাওলাট আইনের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্রিটিশ দ্বারা প্রণীত জঘন্য আইনগুলির মধ্যে রাওলাট আইন ছিল অন্যতম ।
রাওলাট আইন কি ?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে রাজদ্রোহীতা ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করা হয় এবং বৈপ্লবিক আন্দোলন দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রচেষ্টা করা হয়। ১৯১৭ সালে এই উদ্দেশ্যে ভারত সরকার সিডিসন কমিটি গঠন করে। ইংল্যান্ডের বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাট-এর সভাপতিত্বে পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। এই কারণে এই কমিটি “রাওলাট কমিটি” নামেও পরিচিত।
১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে রাওলাট কমিটি তার প্রতিবেদন পেশ করে। ১৯১৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি কমিটির সুপারিশগুলি বিল হিসেবে কেন্দ্রীয় আইনসভায় উথ্থাপিত হয় এবং ১৯১৯ সালের ১৮ই মার্চ তা আইন হিসেবে পাস হয়। এই আইন “রাওলাট আইন” নামে পরিচিত।
রাওলাট আইন প্রবর্তনের কারণ –
- শ্বেতাঙ্গদের খুশি করার চেষ্টা : ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের কিছু কিছু স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার প্রদান করে। এতে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাসম্পন্ন কিছু কিছু ইংরেজ ক্ষুন্ন হয়। এই বিশেষ শ্রেণীকে তুষ্ট করতে সরকার ভারতীয়দের ওপরে এই তীব্র দমনমূলক রাওলাট আইন চাপিয়ে দেয় ।
- ১৯১৫ সালের ভারতরক্ষা আইন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপ দমনের উদ্দেশ্যে সরকার ভারতরক্ষা আইন (Defence of India Act, 1915) নামে একটি দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার সাথে সাথে এই আইনের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। ভারতীয়দের দমন করার জন্য ভারতরক্ষা আইনের মতো একটি দমনমূলক আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ব্রিটিশ সরকার।
- সরকারের সুপারিশ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার বিলাতের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনকে এক পত্রে জানায় যে, যুদ্ধের পর ভারতের পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এই সম্ভাব্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে আগাম ব্যবস্থা নিতে ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনকে অনুরােধ করে।
- গণ আন্দোলন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি ও খড়ার ফলে শস্যহানি, বেকারত্ব, মহামারির প্রকোপ প্রভৃতির ফলে দেশবাসীর অবস্থা শােচনীয় হয়ে ওঠে। সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকায় দেশবাসী ব্রিটিশ সরকারের ওপর অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়। এই ক্ষোভ দিকে দিকে গণ আন্দোলন রূপে ছড়িয়ে পড়ে।
- মুসলিমদের ক্ষোভ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মুসলিম জগতের ধর্মগুরু তুরস্কের খলিফা ইংল্যান্ডের বিপক্ষ জোটের হয়ে যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ যুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সরকার তুরস্কের খলিফার ক্ষমতা হ্রাসে প্রচেষ্ট হয়। এতে ভারতীয় মুসলিমরা বৃটিশদের উপরে ক্ষুব্ধ হয়ে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করে।
- শ্বেতাঙ্গদের অমানবিকতা : দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে প্রচুর ভারতীয় কর্মরত ছিল। সেখানে ব্রিটিশ সরকার ও শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয়দের সঙ্গে খুবই অমানবিক আচরণ করত। এই খবর ভারতে ছড়িয়ে পড়লে ভারতীয়রা এদেশের সরকার ও শ্বেতাঙ্গদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।
- বিপ্লববাদের প্রসার: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বিপ্লবীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের ওপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে শুরু করলে সরকার অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সরকার ভারতীয়দের ওপর প্রচণ্ড দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে সংকটজনক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।
রাওলাট আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য :
এই আইন প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীর সর্বপ্রকার রাজনৈতিক আন্দোলনের অধিকার খর্ব করা এবং সর্বপ্রকার বিপ্লবী কর্মপ্রচেষ্টাকে দমন করা। এ ছাড়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে “ভারতরক্ষা আইনের” মেয়াদ শেষ হলে বিপ্লববাদ দমনের জন্য অনুরূপ একটি আইনের প্রয়োজন ছিল। এইসব তাগিদ থেকেই রাওলাট আইন প্রবর্তিত হয়।
রাওলাট আইনের মূল ধারা :
- সন্দেহজনক যে কোনও ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে
- বিনা বিচারে তাদের অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি রাখা বা নির্বাসন দেওয়া যাবে। এই কারণে গান্ধীজী এই আইনকে কালা আইন বলে অভিহিত করেছেন।
- বিনা সাক্ষ্য প্রমানে বিশেষ আদালতে তাদের বিচার হবে এবং এই বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোনও আপিল করা যাবে না। এজন্য এই আইনকে “না আপিল, না উকিল, না দলিল আইন” বলা হয়।
- এই আইনের দ্বারা সংবাদপত্রের কণ্ঠও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।
রাওলাট আইনের প্রতিক্রিয়া
কেন্দ্রীয় আইসভায় প্রতিটি ‘বেসরকারি’ ভারতীয় সদস্য এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করেন। মহম্মদ আলি জিন্নাহ সহ চারজন এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এই ঘৃণ্য “কালা আইন” -এর তীব্র প্রতিবাদ করে বড়লাট চেমসফোর্ডকে তা কার্যকারী না করার অনুরোধ করেন জানান মহাত্মা গান্ধী। তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে মহাত্মা গান্ধী এই আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ভারতব্যাপী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন। অমৃতবাজার পত্রিকা এই আইনকে “এক ভয়াবহ ভ্রান্তি” বলে অভিহিত করে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড
রাওলাট আইনকে কেন্দ্র করে মহাত্মা গান্ধির আহ্বানে সারাদেশ গণ-আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লে ব্রিটিশ সরকার গুলির বিনিময়ে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে দিল্লি, লাহাের, গুজরানওয়ালা, কাসুর, অমৃতসর প্রভৃতি স্থানে হিংসাত্মক
কার্যকলাপ শুরু হয়।
পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও ডায়ার পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করেন। এরই প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল বিকেলে ৪-৩০ টার সময় অমৃতসর শহরের পূর্বপ্রান্তে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে এক উদ্যানে ১০,০০০ নিরস্ত্র মানুষ শান্তিপূর্ণ সভায় মিলিত হয়। তাদের কোনােভাবেই সতর্ক না করে ৫০টি রাইফেল থেকে টানা ১০ মিনিট ধরে গুলি ছুঁড়ে ২,০০০-এর বেশি নরনারীকে হতাহত করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের এই পাশবিক আচরণে সারা ভারত সাময়িকভাগে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘৃণাভরে তার রাজসম্মান ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন।
[ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পরে প্রকাশ করা হবে ]Covered Topic :
রাওলাট আইন টিকা লেখ, রাওলাট আইন কেন প্রবর্তিত হয়,
দেখে নাও :
ভারতের ঐতিহাসিক সন্ধি ও চুক্তি – তালিকা PDF
কিছু ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও তার লেখক – PDF – ঐতিহাসিক বই
তুঘলক বংশের ইতিহাস : সুলতানি সাম্রাজ্য – PDF
PDF : ৮০০টি আধুনিক ভারতের ইতিহাসের প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্নোত্তরে ইতিহাস |History Questions and Answers
রাওলাট কমিটি কত খ্রিস্টাব্দে নিযুক্ত হয়েছিল ?
১৯১৭
কোন আইন ‘কালা কানুন’ নামে পরিচিত ?
রাওলাট আইন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের আগে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল ?
রাওলাট আইন চালু
Anarchical and Revolutionary Crimes Act আসলে কোন এক্ট ?
রাওলাট এক্ট
রাওলাট অ্যাক্ট যখন পাস হয় তখন ভারতের ভাইসরয় কে ছিলেন
লর্ড চেমসফোর্ড
To check our latest Posts - Click Here