বিশ্ব উষ্ণায়ন – গ্লোবাল ওয়ার্মিং – Global Warming
Global Warming
বিশ্ব উষ্ণায়ন – গ্লোবাল ওয়ার্মিং (Global Warming )
বিশ্ব উষ্ণায়ন : প্রিয় পাঠকেরা, আজকে আমরা আলোচনা করবো গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন কাকে বলে ?
পরিবেশ দূষণের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বিপদজনক ভাবে বেড়ে চলেছে। সারা বিশ্ব জুড়ে এই ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা বৃদ্ধির সার্বিক প্রবণতাকেই বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলে।
বিশ্ব উষ্ণায়নে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব
বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি বেড়ে যাওয়ার ফলে সূর্য থেকে আগত ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মিগুলি খুব সহজে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে আস্তে পারে কিন্তু ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত /প্রতিফলিত দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই সৌরকিরণের অংশ গ্রিনহাউস গ্যাস দ্বারা শোষিত ও বিকিরিত হয়ে আর মহাকাশে ফিরে যেতে পারে না ও পুনরায় ভূপৃষ্ঠে ফিরে এসে নিম্ন বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতাকে বাড়িয়ে দেয়।
২০১৪ সালে প্রকাশিত IPCC ( Intergovernmental Panel on Climate Change ) এর তথ্য অনুসারে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী হলো বায়ুমণ্ডলের ক্রমবর্ধমান গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপ।
বিশ্ব উষ্ণায়নে বিভিন্ন গ্রীনহাউস গ্যাসগুলির ভূমিকা নিচে দেওয়া রইলো।
১. কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2 ) ও বিশ্ব উষ্ণায়ন :
গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য অন্যতম দায়ী গ্যাসটি হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড। বায়ুতে মাত্র ০.০৩% থাকলেও পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধিতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভূমিকা প্রায় ৪৯%। পৃথিবীতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রধান কারণগুলি হলো –
১. অরণ্য ধ্বংস ও অপরিণত বৃক্ষছেদন।
২. জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, খনিজতেল ) প্রভৃতির অতিব্যবহার।
৩. অগ্নুৎপাত।
৪. দাবানল।
৫. জনবিস্ফোরণ।
৬. কলকারখানার ধোঁয়া।
পৃথিবীতে দিন দিন যে পরিমানে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বিশ্ব উষ্ণায়নের হাত থেকে পৃথিবীকে রাখা করা দুষ্কর হয়ে পরছে ।
২. মিথেন গ্যাস (CH4 ) বৃদ্ধি ও বিশ্ব উষ্ণায়ন :
পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মিথেনের ভূমিকাও কিছু কম নয়। কারণ ডাইঅক্সাইড-এর তুলনায় বায়ুতে কম থাকায় গ্রিনহাউস প্রভাব সৃষ্টিতে যদিও এর ভূমিকা কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর থেকে একটু কম। তবে উল্লেখ্য যে মিথেন কিন্তু কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর তুলনায় প্রায় দ্বিগুন বেশি তাপ ধরে রাখতে পারে।
বায়ুতে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলি হলো –
১. পচা জৈব আবর্জনা বৃদ্ধি।
২. বায়োমাস প্রজ্জ্বলন।
৩. গৃহপালিত পশু ও কীটের অন্ত্রের কোহল।
৪. আবদ্ধ বর্জ্যবস্তু সমৃদ্ধ জলাভূমি।
৫. ধানক্ষেত, গ্যাস ও কয়লাখনি অঞ্চলে দহন প্রভৃতি।
অনুমান করা হয় যে ২০৫০ সালের মধ্যে বায়ুতে মিথেন গ্যাসের পরিমান প্রায় দ্বিগুন হয়ে যাবে যা পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
৩. ক্লোরোফ্লুরো কার্বন ও বিশ্ব উষ্ণায়ন :
বিশ্ব উয়ায়নে ক্লোরােফ্লুরােকার্বনের (CFC) ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। এক অণু CFC-এর উষ্ণকরণ ক্ষমতা ১০,০০০ CO2 অণুর মােট উষ্ণকরণ ক্ষমতার সমান।
এই গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান উৎসগুলি হল –
১. রেফ্রিজারেটার, এয়ার কন্ডিশনার তৈরি,
২. ফোম ও প্লাস্টিক তৈরি,
৩. স্প্রে-ক্যান, বিমানের প্রপেলার প্রস্তুতি,
৪. চিকিৎসায় ব্যবহৃত জীবাণুনাশক প্রভৃতি।
তাপ শােষণ ছাড়াও এই গ্যাস ওজোন স্তরের ক্ষয় ঘটিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌছে দেয় এবং পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধিতে পরােক্ষভাবে সাহায্য করে।
৪. নাইট্রাস অক্সাইড ও বিশ্ব উষ্ণায়ন :
বায়ুমণ্ডলে নাইট্রাস অক্সাইডের (N2O) বৃদ্ধি বিশ্ব উষ্ণায়নের আর একটি প্রধান কারণ।
এই গ্যাস বৃদ্ধির জন্য দায়ী –
১. কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের ব্যবহার,
২. জীবাশ্ম জ্বালানির দহন,
৩. সার শিল্প,
৪. ফসলের অবশেষ পচন ও কাঠ জ্বালানি,
৫. মাটিতে অণুজীবক্রিয়া প্রভৃতি।
৫. অন্যান্য গ্যাস বৃদ্ধি ও বিশ্ব উষ্ণায়ন :
এ ছাড়া নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2 ), কার্বন মনােঅক্সাইড (CO ), সালফার ডাইঅক্সাইড (SO2 ), ইথেন (CH3 ) প্রভৃতি গ্যাস ও জলীয় বাষ্প পৃথিবীর বিকিরিত তাপ ধরে রেখে পৃথিবীর উয়তা বৃদ্ধি করে চলেছে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাব
পরিবেশে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির পরিমাণের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও প্রধান ফলাফল হল—ভূমণ্ডলব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি বিশ্ব উষ্ণায়ন। এই উষ্ণতা পরিবর্তনের জন্য পরিবেশের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব শৃঙ্খল আকারে দেখা যায়। যেমন –
গড় উষতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন : শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ব্যাপক হারে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর গড় উষ্ণুতা প্রায় 1.5°C বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাস বিশেষত CO2-এর পরিমাণ আরাে বৃদ্ধি পেলে আগামী শতকে এই বৃদ্ধি 3°C ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর ফলে শীতের চেয়ে গ্রীষ্মের প্রকোপ বাড়বে। ঋতুগুলির আগমন অনিয়মিত হয়ে পড়বে, ঘূর্ণি ঝড়, বজ্র ঝড়, খরার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি ইত্যাদি ঘটতে দেখা যাবে।
সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি ও আনুষঙ্গিক পরিবর্তন : বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে কুমেরু মহাদেশের গভীর পুরু বরফের স্তর, অন্যান্য মহাদেশীয় ও পার্বত্য হিমবাহ দ্রুত গলতে থাকবে এবং এই বরফগলা জল সমুদ্রে যুক্ত হয়ে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা আরাে বৃদ্ধি করবে। এর ফলে উপকূলবর্তী এলাকার নীচু অংশ জলমগ্ন হওয়ার পাশাপাশি মাটির উর্বরতা হ্রাস, কৃষিজমি হ্রাসের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, ভূমিরূপের পরিবর্তন, সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন ইত্যাদি বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হবে।
জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব : বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হবে। অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ চিরতরে হারিয়ে যাবে। গবেষক ডেনিস মাফি পর্যবেক্ষণজনিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের গড় উষ্ণতা ৩°C বৃদ্ধি পেলে ৪০% স্তন্যপায়ী, ২৩% প্রজাপতি ও কয়েক শতাংশ পাখি চিরতরে বিলুপ্ত হবে।
জলজ বাস্তুতন্ত্রে বিঘ্ন : সমুদ্রজলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে তাতে বায়ুমণ্ডলীয় CO2 -এর দ্রাব্যতা কমে যাবে। দ্রবীভূত CO2-এর অভাবে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনগুলি মারা যাবে, ফলে, জলজ বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়বে, অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর অবলুপ্তি ঘটবে।
দাবানল : উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গাছে গাছে ঘষা লেগে দাবানল সৃষ্টি ও তার মাধ্যমে বিস্তীর্ণ বনভূমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
ভৌমজলের ঘাটতি : বিশ্ব উয়ায়নের প্রভাবে মৃত্তিকায় জলের পরিমাণ হ্রাস পাবে। এর ফলে ভৌমজলের ভাণ্ডারে টান পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব : বেশি উয়তায় জীবাণু সংক্রমণ বৃদ্ধি ওয়ায় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াঘটিত বিভিন্ন রােগের (ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গ, হাঁপানি, অ্যালার্জি) প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে।
এককথায় বলা যায়, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ, মানুষ এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখােমুখি হবে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রতিকারের উপায় :
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস : জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস) যথাসম্ভব কম ব্যবহার করে বাতাসে CO2-এর পরিমাণ হ্রাস করা সম্ভব। জ্বালানিহীন যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি ও সেই লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ (যেমন—অল্প দূরত্বে সাইকেলের ব্যবহার, সাইকেল চালানাের জন্য আলাদা ফুটপাথ তৈরি), ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে কারপুলিং ব্যবস্থা এক্ষেত্রে আবশ্যক। ইউরােপীয় দেশগুলিতে ও এশিয়ার চীনে এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপরতা দেখা যায়।
অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি : অপ্রচলিত শক্তি যেমন সৌরশক্তি, জোয়ারভাটা শক্তি, বায়ুশক্তি, ভূতাপীয় শক্তি ইত্যাদি অদূষক হওয়ায় তাদের ব্যবহার বৃদ্ধি করে বিশ্ব উয়ায়নের মােকাবিলা করা সম্ভব।
ফ্রেয়ন উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা : ফ্রেয়ন (CFC-11 ও CFC-12) ও হ্যালন গ্যাসের উৎপাদন ও ব্যবহার বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ করা প্রয়ােজন।
বনসৃজনে উৎসাহদান : অরণ্য ধ্বংস হ্রাস, বৃক্ষরােপণ ও বনসৃজনের দিকে নজর দিতে হবে যাতে উদ্ভিদ বাতাসের অতিরিক্ত CO2, শােষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
প্রযুক্তির উন্নতি : শিল্পক্ষেত্র ও যানবাহনে ব্যবহৃত ইঞ্জিনের দক্ষতা বাড়ানাের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা আবশ্যক যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির অপচয় ও ব্যবহার কমিয়ে বাতাসে CO2-এর পরিমাণ কমানাে যায়।
আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণ : মিথেন উৎপাদনকারী আবর্জনার সঠিক প্রক্রিয়াকরণ ঘটিয়ে বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের সঞ্চয় কমাতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : বিশ্ব উষ্ণায়নের কুপ্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এই কর্মসূচিতে ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করলে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস সাফল্যলাভ করার সম্ভাবনা বাড়ে।
নাইট্রোজেনঘটিত সার ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ : বায়ুতে নাইট্রাস অক্সাইড ও অন্যান্য নাইট্রোজেনঘটিত অক্সাইডের নির্গমন বন্ধ করতে কৃষিজমিতে নাইট্রোজেনঘটিত সারের পরিবর্তে জৈবসারের ব্যবহার বাড়ানাে দরকার।
গবেষণায় উৎসাহ দান : গ্রিনহাউস গ্যাস কমানাের উপায় উদ্ভাবনের জন্য গবেষণার কাজে প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প সংস্থাগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। এ জাতীয় গবেষণাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, গবেষকদের আর্থিক ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা বৃদ্ধি একান্তই প্রয়ােজন।
আরো দেখে নাও :
বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস ( PDF + MCQ ) | বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর
খাদ্য সংরক্ষণ ও সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি
পানীয় জলে বিভিন্ন রাসায়নিকের সহনীয় মাত্রা
বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রবন্ধ রচনা, পরিবেশ রক্ষা ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারন ও ফলাফল, বিশ্ব উষ্ণায়ন, পরিবেশ এবং আমরা
To check our latest Posts - Click Here