রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল যেন ‘চাঁদের হাট’। মনীষীদের এমন একত্রিত সমাবেশ খুব কমই ঘটে থাকে। বিশ্ববিখ্যাত এই পরিবার বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। কারণ ধর্ম ও সমাজসংস্কারক, খ্যাতনামা শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, গীতিকাব্য, নাট্যকার, গায়ক, অভিনেতা – এককথায় ধরণের সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপকার ও ধর্মসংস্কারকদের লীলাভূমি ছিল জোড়াসাঁকো।
দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙালি শিল্প বাণিজ্যের উদ্যোক্তা। নীলমনি ঠাকুর জোড়াসাঁকোয় এক সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তবে নীলমনির পুত্র রামলোচন অপুত্রক হওয়ায় দ্বারকানাথকে দত্তক নেন। এই দ্বারকানাথ বণিক হিসেবে খ্যাত ও রামমোহনের বন্ধু ছিলেন। দ্বারকানাথের পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ গ্রহণ করে তাঁর সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবতুল্য এই ভক্তসাধকের নিকটে ঐশ্বরীয় কথা শুনতে যেতেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙালি লেখক, সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ। শুধু তাই নয় তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম এশীয় ব্যারিষ্টার। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন খ্যাতনামা ভারতীয় বাঙালি চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক ও লেখক। এই পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ।
জন্ম :
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ ( ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর এই ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অষ্টাদশ শতকে আধুনিকতার উন্মেষে এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশে এই পরিবারের ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে উঠেছিল।
শিক্ষা :
প্রথমে রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়েন, তারপর নর্মাল স্কুল ও বেঙ্গল একাডেমিতেও পড়াশোনা করেন। চিরাচরিত বাঁধাধরা স্কুলজীবনকে তিনি পছন্দ করতেন না। তাই বিশিষ্ট শিক্ষকবৃন্দের সাহচর্য্যেই তাঁর স্বগৃহে বিদ্যাভাস করতে থাকেন। বাড়িতে সংস্কৃত, ব্যাকরণ, পার্শী, ইংরেজি ভাষা শেখেন। সেই সঙ্গে জ্যামিতি ও বিজ্ঞানচর্চাও করতেন।
১৮৭৮-এ প্রথম তিনি বিলেত যান। কিছুদিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। দেড়বছর পরে স্বদেশে ফেরেন। এরপর ঠাকুর পরিবারের সৃষ্টিশীল পরিমণ্ডলেই তাঁর ক্যব্যচর্চার সূচনা হয়। বড়দের উৎসাহে তাঁর কাব্য চর্চার স্পৃহা বাড়তে থাকে। বৌদি কাদম্বিনীর প্রেরণায় হিন্দুমেলা, বিদ্বজ্জন সভায় কবিতাপাঠ করেন। শৈশবেই প্রকাশিত হলো শৈশবসঙ্গীত। মাত্র ১৬বছর বয়সেই লিখলেন ভানুসিংহের পদাবলী।
কাব্যসাধনা :
‘সন্ধ্যা সংগীত’ থেকে ‘কড়ি ও কোমল’ পর্যন্ত এক বিশেষ পর্ব। ‘প্রভাত সংগীতে’ রোমান্টিকতা থেকে বেদনা মুক্তির ইতিহাস। ‘মানসী’ কাব্যে ফুটে ওঠে প্রেমচেতনার দেহাতীত রূপ। ‘চিত্রায়’ জীবনদেবতার পদধ্বনি শোনেন। একে একে লিখে গেলেন অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ – চৈতালী, নৈবদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, বলাকা, পূরবী, মহুয়া ইত্যাদি। খ্যাতির উচ্চ শিখর লাভ করেন – ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের মাধ্যম্যে।
” আমি রূপে তোমায় ভোলাব না , ভালোবাসায় ভোলাব । / আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো , গান দিয়ে দ্বার খোলাব / ভরাব না ভূষণভারে , সাজাব না ফুলের হারে – / প্রেমকে আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাব । – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রেম )
উপন্যাস :
শুধু কি কাব্যগ্রন্থ, তিনি লেখেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কয়েকটি উপন্যাস। সেগুলি হল – ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’, ‘যোগাযোগ’, ‘গোরা’, ‘শেষের কবিতা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’, ‘চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি। ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ কিংবা ‘করুণা’, ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসগুলিও সমধিক জনপ্রিয় ছিল। তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাস ‘রাজর্ষি’ থেকে শেষ বয়সের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ পর্যন্ত সবগুলির মধ্যেই একটা বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল তিনি আপন সৃষ্টিকে স্বাতন্ত্রতা দান করেছেন।
নাট্য সাহিত্য :
কবিতা, উপন্যাসেই তাঁর প্রতিভা সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাঁর অজেয় কয়েকটি কালজয়ী নাটক হল, ‘রক্তকবরী’, ‘বিসর্জন’, ‘অচলায়তন’, ‘গোড়ায় গলদ’ ইত্যাদি। তবে ‘ডাকঘর’ কিংবা ‘চিরকুমার সভা’ নাটকও বৈচিত্রে পূর্ণ ছিল। কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য সব বিভাগেই তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। নাট্যব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন – “বলতে গেলে ১৯২৬ সালই রবীন্দ্রনাথের নাটকের শ্রেষ্ঠ ফসলের যুগ”। ‘শোধবোধ’, ‘নটির পূজা’, ‘ঋতু উৎসব’, ‘রক্ত কবরী’ – এই বছরেই প্রকাশিত হয়।
গীতিনাট্য :
‘কালমৃগয়া’, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘মায়ার খেলা’ প্রভৃতি গীতিনাট্যের মধ্যেও তাঁর রচনাশৈলী অতুলনীয় ছিল। রবীন্দ্ৰনাথের নাটকে গানের প্রয়োগ যথাযথ।
গল্প :
গল্পের ভান্ডারও তাঁর নিতান্ত কম নয়। কয়েকটি শ্রেষ্ঠ গল্প হল, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘অতিথি’, ‘শাস্তি’, ‘বলাই’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘গুপ্তধন’, ‘মনিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষান’, ‘দেনা পাওনা’ ইত্যাদি।
প্রবন্ধ গ্রন্থ :
বিশ্বকবির প্রবন্ধ গ্রন্থগুলিও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাঁর রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো – ‘সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’, ‘ধর্ম’, ‘শিক্ষা’, ‘কালান্তর’, ‘সভ্যতার সংকট’ ইত্যাদি।
গান:
রবীন্দ্ররচিত গান আজ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ হিসাবে অমরত্ব লাভ করেছে। তিনি প্রায় তিনহাজারটি গান লিখেছেন। তাঁর লেখা সঙ্গীত ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
” মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে , মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই । এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয় – মাঝে যদি স্থান পাই । ” – রবীন্দনাথ ঠাকুর (কড়ি ও কোমল )
বঙ্গভঙ্গ ও রবীন্দ্রনাথ :
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। রাখিবন্ধন উৎসবের সূচনা করে সকলের রাখি পরিয়ে দেন। লিখলেন –
“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল–
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥
নাইট উপাধি ত্যাগ :
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগের পাশব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইট উপাধি ত্যাগ করেন।
শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা :
একটি আদর্শ শিক্ষাক্ষেত্ররূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরভূমের বোলপুর মহকুমার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে একটি উপসনাকক্ষ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গড়ে তোলেন। এটাই পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালে পাঠভবনে পরিণত হয়। তারপর এখানেই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এর অদূরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কৃষি, শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র শ্রীনিকেতন।
প্রয়াণ :
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশ্বকবি অসুস্থ হয়ে পরেন। তবু সৃষ্টির অদম্য ইচ্ছা তাঁর সাহিত্য কর্মেও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। কলকাতায় তাঁর অস্ত্রোপ্রচারও হয়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট ( ২২শে শ্রাবন ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ ) তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
“যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই
যা পেয়েছি যা দেখেছি তুলনা তার নাই” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উপসংহার :
সাহিত্যের এমন কোনো শাখা ছিল না যাতে তাঁর অবদান ছিল না। বাংলা সাহিত্যের আকাশে দীপ্তসূর্যের মত তিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এইভাবে – “তোমার গুনে বাঙ্গলা তো চিরদিনই মুগ্ধ – ভারত গৌরবান্বিত, এখন পূর্ব ও পশ্চিম, নূতন ও পুরাতন সকল মহাদেশই তোমার প্রতিভায় উদ্ভাসিত।” সারাবিশ্বে তিনি যে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তা এই মন্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয়।
আরো দেখে নাও :
বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্র ও তাদের স্রষ্টা ( PDF )
বাংলা সাহিত্যের উৎসর্গীকৃত রচনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুইজ – বিশ্বকবি স্পেশাল – সেট ১৩১
To check our latest Posts - Click Here